আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। ৫০ বছরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের বাংলাদেশ—উন্নয়নের বিস্ময় এক বাংলাদেশ। ১৯৭৫-এর পরবর্তী সময় থেকে ডিসেম্বর ১৯৯০ পর্যন্ত ১৪ বছর সামরিক শাসনের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ছিল খুব মন্থর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যত স্থবির। যেমন সরকারি কারখানাগুলোর জাতীয়করণ থেকে বেসরকারীকরণ করলেও সেগুলো ছিল অসংগঠিত, পুঁজি সঞ্চয়নে ধীরগতি। বৈদেশিক বাণিজ্য উদারীকরণের পর ১৯৯০-এর পরবর্তী সময় থেকে অর্থনীতির গতিধারা দ্রুত বদলাতে শুরু করে এবং ২০০৯-এর পর থেকে আরো গতিশীল হয়। তারই ফলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী ২০১৫ সালের নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন এবং ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। সে লক্ষ্য ২০১৫ সালেই অর্জিত হয়ে যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ২০১৮ সালের জাতিসংঘের মানদণ্ডে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের শর্ত পূরণ করেছে এবং ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো শর্তগুলো পূরণ করে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা লাভ করবে। সহস াব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রভূত সাফল্য অর্জন করে। বিশেষত মাতৃমৃত্যু হার, দারিদ্র্যের হার, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়নে এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

২০২০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে স্থির মূল্যের সমতায় জিডিপির আকার ৩০তম এবং চলতি ডলার মূল্যে অবস্থান ৩৯তম। সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালেই বাংলাদেশ নামিক জিডিপি আকারে ৩০তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে। আর হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের হিসাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতিতে এবং সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইউবিএসের মতে, বাংলাদেশ ২০৫০ সালে ১২তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদনে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। অথচ এক দশক আগেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ছিল ভারতের অর্ধেক। এভাবে বাংলাদেশ এশিয়ার একটি সফলতার গল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেকে বাংলাদেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ নামেও অভিহিত করছে। বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে চতুর্থ, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়। আজ আমরা খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা চালে স্বাধীনতার পর থেকে সাড়ে তিন গুণের বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। বাংলাদেশের এই রূপান্তরের পেছনে যে চালিকাশক্তিগুলো কাজ করেছে, সেগুলো হলো সরকারের উন্নয়ন নীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গ্রামাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃতি, সামাজিক পরিবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণ, তৈরি পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য সামাজিক সূচকে (প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিক্ষা ও জেন্ডার সমতায়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমানো) উন্নতি। এবার অর্থনীতির মূল সূচকগুলোর দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক, তাহলে গত পাঁচ দশকে রূপান্তরের গভীরতা আরো পরিষ্কার হবে।

বিগত দশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের যে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে বা নজর কেড়েছে, সেটি হলো ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি। ২০০৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার সাড়ে তিন গুণের বেশি বেড়েছে। গত ৫০ বছরের মধ্যে গত দশকে গড় প্রবৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল (৬.৭৬ শতাংশ)। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রতি দশকে ১ শতাংশ পয়েন্ট প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এটি একটি অনন্য অর্জন। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বিনিয়োগের সমাবেশ ঘটায় প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে এবং আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবৃদ্ধির হার ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে ২০৪১ সময় পর্যন্ত ১০ শতাংশ হবে বলে আশা করা যায়। প্রথমত, বিনিয়োগের জন্য দরকার ভৌত অবকাঠামো সৃষ্টি। বিগত দশকে সরকারের সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার খাত ছিল অবকাঠামো। এজন্য যে মেগা প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়েছে, যার ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১-২ শতাংশ ত্বরান্বিত হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার ব্যবসার পরিবেশ উন্নতকরণে বেশকিছু সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ফলে গত বছর বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে আট ধাপ উন্নীত হয়েছে। ব্যবসার জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু হওয়ায় আরো উন্নতি লাভ করবে।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা; যা অর্থনীতি রূপান্তরের অন্যতম শর্ত। বিগত দশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে প্রবৃদ্ধির গতির ধারাবাহিকতা থাকবে। চতুর্থত, সরকারের ব্যবসাবান্ধব নীতি। সরকার ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণ করে। তার মধ্যে একটি হলো মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, মহেশখালী মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল। সব মেগা প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের কাছাকাছি, যা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে সুফল পাওয়া শুরু হবে।

মাথাপিছু জাতীয় আয়কে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি ধরা হয়। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় আয় খুব বেশি বাড়েনি। ১৯৯০-এর দশক থেকে তা গতিশীল হতে শুরু করে এবং চলতি দশকে বৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনার মূল দুটি অভীষ্ট হচ্ছে ২০৩১ সালের মধ্যে নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। বিশ্বব্যাংকের শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী ২০২০-২১ সালে নিম্নমধ্যম আয় থেকে উচ্চমধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার সীমা হলো মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৪৫ মার্কিন ডলার (এটলাস পদ্ধতিতে)। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লে মাথাপিছু আয়ও বাড়বে, যদি জনসংখ্যা সে অনুপাতে বৃদ্ধি না পায়। সে কারণে আমাদের উন্নয়ন নীতিতে প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ। প্রবৃদ্ধি বাড়লে মানুষের চাহিদা বাড়বে। চাহিদা বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ও মানুষের আয় বাড়বে। আগামীতে (২০৩০-এর মধ্যে) সরকারের ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিত বলা যায়, পুরো বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে।

বাংলাদেশ একসময় কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। মোট দেশজ উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি আসত কৃষি থেকে আর কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ। জিডিপিতে শিল্পের অবদান ছিল ১২-১৩ শতাংশের মতো। ধীরে ধীরে কৃষির অবদান কমে শিল্প ও সেবা খাতের পরিধি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক থেকে শিল্প খাতের অবদান বাড়তে শুরু করে প্রধানত তৈরি পোশাক শিল্পের প্রসারের কারণে। এখন সেবা খাতের অবদানও কমে যাচ্ছে। তার স্থান নিচ্ছে শিল্প। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ, যদিও কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল শ্রমশক্তি ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে শিল্প খাতের অবদান ৩৫ শতাংশ। রূপকল্প ২০৪১ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৩১ সালের মধ্যে শিল্প খাতের অবদান ৪০ শতাংশ হবে, যদিও ধীরে ধীরে তা কমে ২০৪১-এ আবার ৩৫ শতাংশে নেমে আসবে এবং সেবা খাত সম্প্রসারিত হবে। তখন কৃষির অবদান থাকবে মাত্র ৫ শতাংশ। ২০৪১ সালে মাথাপিছু বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি বলে ধরা হয় প্রবাসী আয় ও রফতানিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমাদের এক কোটির ওপরে প্রবাসী থাকে। প্রবাসী আয় আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার অন্যতম উৎস। মূলত গত ২০ বছরে প্রবাসী আয় নয় গুণ বেড়েছে।

করোনার কারণে বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে শুরু করে অনেক অর্থনীতিবিদ অনুমান করেছিলেন, করোনার সময়ে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। সব অনুমান ভুল প্রমাণিত করে চলতি প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাচ্ছে। জুলাই, ২০২০-এ সর্বকালের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় (২.৫৯ বিলিয়ন ডলার) এসেছে। চলতি অর্থবছরে গড়ে মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের ওপর আসছে প্রবাসী আয়। তৈরি পোশাক শিল্পের আগে একসময় পাট ছিল অন্যতম রয়তানি পণ্য। আশির দশকে সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দেশের তুলনামূলক সুবিধা ও সস্তা শ্রমের সুবাদে তৈরি পোশাক শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করে। বিশেষ করে গত দুই দশকে পোশাক শিল্পের প্রসারের ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে মোট রফতানির ৮৪ শতাংশের ওপর আয় আসে তৈরি পোশাক থেকে। তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত চার মিলিয়ন শ্রমিক, যার ৮০ শতাংশই নারী। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে রফতানি আয় ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

একসময় বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুব কম ছিল। ডলারের ওপর কড়াকড়ি ছিল। সে সময় এখন অতীত। প্রবাসী আয় এবং রফতানি আয়ের ফলে রিজার্ভ গত দুই দশকে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে যায়। এ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে তিন গুণ রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৯-৮০ সালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০০৯-১০-এ ছিল ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফেব্রুয়ারি ২০২১-এ রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অত্যধিক এই রিজার্ভ তহবিল থেকে এখন অবকাঠামো উন্নয়নে দেশে প্রথমবারের মতো ‘অবকাঠামো বিনিয়োগ তহবিল’ গঠন করা হয়েছে। পাকিস্তানে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন মাকিনণ ডলার—বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেকের কম।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যতটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় নজর কেড়েছে, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ হয়েছে সামাজিক সূচকগুলোর অগ্রগতি। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় গত দুই দশকে বাংলাদেশ মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে এগিয়েছে, তা বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।

মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে আছে, যদিও পাকিস্তানের সঙ্গে খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে। অন্যদিকে ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫৩ বছর এবং অন্য দুটি দেশের তুলনায় কম। অথচ চার দশকে বাংলাদেশ তাদের চেয়ে অনেক এগিয়েছে। একইভাবে শিশুমৃত্যুর হার, নবজাতকের মৃত্যুর হার, পাঁচ বছরের নিচে মৃত্যুর হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একসময় অনেক পিছিয়ে থাকলেও এখন এগিয়ে রয়েছে। একথা বলে রাখা দরকার বাংলাদেশ ২০২০ সালের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ৯৪তম ও ৮৮তম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সূচকে অগ্রগতির আরেকটি কারণ হলো নারীদের মোট সন্তান জন্মহার কমে যাওয়া। একটা সময় ছিল সত্তরের দশকে নারীপ্রতি গড় সন্তান জন্মহার ছিল ৭-এর কাছাকাছি। সেই অবস্থা থেকে আজকে এ হার মাত্র দুজন। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ জেন্ডার সমতায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে গত ৫০ বছরে পুরুষের চেয়ে নারীরা অধিক সময় শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।

অতীতের গৌরব ও অর্জন ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। প্রজ্ঞাশীল সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় যদিও অর্থনীতি এখন স্থিতিশীল, তবে আত্মতুষ্টিরও সুযোগ নেই। আমাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম। আমাদের ১৫-২৯ বছর বয়সীদের এখনো ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষা, কাজে ও প্রশিক্ষণে যুক্ত নেই, মানে বেকার। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতে হবে। ভবিষ্যতে উন্নত দেশ হতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজের বিকল্প নেই। রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। অনলাইন শ্রমবাজারে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ বিশ্বে জনসংখ্যায় অষ্টম বৃহত্তম। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে আমাদের ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে আরো মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ থেতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। সে কারণে রফতানি পণ্যের ভেতরে ও বাইরে বহুমুখীকরণে নজর দিতে হবে। শিক্ষার মান ও প্রয়োগ উপযোগিতা বাড়াতে হবে। মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষভাবে আমাদের পানি ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক অবকাঠামো খাতে আগামী ১০ বছরে আরো বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আমাদের বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের পাশাপাশি নিজেদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে মতবিভেদ ভুলে আমাদের দেশ গড়ায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।