ড. শামসুল আলম: বিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্ব সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্টের প্রথম লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ১৯৯০ সাল থেকে বিদ্যমান দারিদ্র্যের হার ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেকে কমিয়ে আনা এবং বাংলাদেশ তা অর্জনে সফল হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে কভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ১১০ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। ১৯৯০ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৯০ কোটি থেকে ২০১৫ সালে ৭৩ দশমিক পাঁচ কোটি এবং ২০১৮ সালে ৬৫ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ২৮ হাজার মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের এখন যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রক্ষেপণ, তা ২০১৭ সাল পর্যন্ত হালনাগাদ করা। হালনাগাদ উপাত্ত না পাওয়ার কারণ দক্ষিণ এশিয়া, সাব সাহারান আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের সর্বশেষ প্রাক্কলন জানা যাচ্ছে না। পৃথিবীর ইতিহাসের বড় অংশে অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল। খ্রিষ্টাব্দের শুরু থেকে যদি সময়টা বিবেচনা করা হয়, তবে প্রথম এক হাজার বছরে মানুষের জীবনযাত্রার কোনো পরিবর্তন হয়নি। একটা স্থবির সময় ছিল সেটা। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের পর ইতালীয় রেনেসাঁ যুগে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। পরবর্তী কয়েক শতক সমৃদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের আবির্ভাব ঘটে। এ সময় শিল্পায়নের বিস্তার হতে থাকে এবং সেইসঙ্গে জীবনযাত্রার পরিস্থিতির ক্রম-অগ্রগতি সাধিত হয়। বিশেষ করে ১৯৬০-এর দশকে প্রযুক্তিগত ও স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে দ্রুত উন্নতি সাধিত হতে থাকে। দরিদ্র দেশগুলোতেও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে।

বিগত দুই শতকে শিল্পবিপ্লব এবং আধুনিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়। বিশ্বব্যাংকের বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের হিসাব পাওয়া যায় ১৯৮১ সাল থেকে। গবেষকরা জীবনযাত্রার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিকট অতীতের দারিদ্র্যের একটা হিসাব বের করেছেন। ২০০২ সালে অর্থনীতির প্রখ্যাত জার্নাল ‘আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউ’তে প্রকাশিত ‘ইনইকুয়ালিটি এমাং ওয়ার্ল্ড সিটিজেন: ১৮২০-১৯৯২’ থেকে জানা যায়, ১৮২০ সালে ক্রয়-সক্ষমতার সমতা মাথাপিছু দিনপ্রতি এক ডলার হিসেবে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮৪ শতাংশ এবং দুই ডলারে ৯৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ক্রয়-সক্ষমতার সমতার বিচারে ১.৯ ডলার (২০১১ স্থির মূল্য) ১৯৮১ সালের বিশ্বদারিদ্র্য ৪৪ শতাংশ থেকে বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে দাঁড়িয়েছে। এটা অভাবনীয়, এ কারণেও যে, বিগত ২০০ বছরে জনসংখ্যা সাতগুণ (১০০ কোটি থেকে ৭০০ কোটি) বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব গড় দারিদ্র্য হারের দ্বিগুণ এখনও আমাদের গড় দারিদ্র্য হার।

উন্নয়ন বলতে আমরা বেশিরভাগ সময় প্রবৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি বুঝে থাকি। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা আয় কতটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটি কতটুকু নাগরিক জীবন-মান উন্নয়নে প্রতিফলিত হচ্ছে। জাতিসংঘের মানোন্নয়ন সূচক হচ্ছে সেটির একটি স্বীকৃতি যে, আমাদের শুধু আয় বা প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দিলেই চলবে না। প্রথম মানোন্নয়ন প্রতিবেদনে এই উপসংহারে উপনীত হওয়া গেছে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জীবন-মানের অগ্রগতি স্বয়ংক্রিয় নয়। পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হকের ভাষায় এর উদ্দেশ্য হলোÑ‘উন্নয়ন অর্থনীতির কেন্দ্র জাতীয় আয় হিসাব থেকে জনগণের মানোন্নয়নকেন্দ্রিক নীতিতে সরিয়ে নেয়া।’ পরবর্তীকালে যার কাজের ভিত্তিতে মানব উন্নয়ন সূচক প্রবর্তন করা হয়, তিনি হলেন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন ধরনের মানববঞ্চনাগুলোকে মিটমাট করতে হবে। তিনি মানব উন্নয়ন হিসাবকে সমাজে মানুষ কীভাবে বাস করে, সেসব তথ্যের পদ্ধতিগত নিরীক্ষা বলে অভিহিত করেছেন। ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট (এমডিজি): ২০০১-২০১৫’-এর সূচকগুলোর মধ্যেও দেখা গেছে দারিদ্র্যের বৃদ্ধি/হ্রাসের সঙ্গে অন্যান্য সূচক, যেমনÑকম ওজন, অপুষ্টি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তি, মাধ্যমিক শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীর ভর্তির অনুপাত প্রভৃতির কার্যত জোরালো কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বব্যাংকের এমডিজি প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, মাথাপিছু জিডিপির বৃদ্ধির সঙ্গে এমডিজির আয়-বহির্ভূত অন্যান্য সূচকের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রথম প্রকাশের ২০ বছর পরও একই উপসংহারে উপনীত হওয়া গেছে। সেটি হলো, জাতির প্রকৃত সম্পদ জনগণ। তাই তো জনগণকেন্দ্রিক নীতিকে এমন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমার্থক নয়। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সম্ভব। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর একটি প্রতিবেদন প্রণিধানযোগ্য। সেখানে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তুলনা দেখানো হয়েছে। ১৯৯০ সালে দেখা যায় বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তান থেকে সব সূচকে পিছিয়ে। ২০ বছর পর এখন দেখা গেল বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়সহ সব প্রধান সামাজিক সূচকে এগিয়ে রয়েছে, পেছনে ফেলেছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে।

২০১০ সালেই মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রথম বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক (এমপিআই) প্রবর্তন করা হয়। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (ওপিএইচআই) এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। দারিদ্র্য শুধু আয় দিয়ে নয়, বরং মানবজীবনের অন্যান্য বঞ্চনাভিত্তিক বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে নির্ণেয়। দারিদ্র্যের ধারণা একেক জনের কাছে একেক রকম। বিশ্বব্যাংকের অংশগ্রহণমূলক দারিদ্র্য মূল্যায়নের প্রতিবেদন ৫০টি দেশের ৪০ হাজার মানুষের ওপর জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়, যা এই ধারণাকে পাকাপোক্ত করে। অনুরূপভাবে জাতিসংঘের উন্নয়ন গ্রুপ ২০১৩ সালে ১৯৪টি দেশের আট লক্ষাধিক মানুষের ওপর জরিপ করে। জরিপের বিষয় ছিল ছয়টি অগ্রাধিকারপূর্ণ মানব উন্নয়নের বিষয় নির্ধারণ করা। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও চাকরির সুযোগ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে বলা হয়েছে, সব ধরনের ও সব মাত্রার দারিদ্র্য ও বঞ্চনা দূরীকরণ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অভীষ্ট-১-এর লক্ষ্যমাত্রা ১.২ এ বলা হয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী সব মাত্রার দারিদ্র্য অর্ধেকে কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। মোদ্দা কথা, এমপিআইয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিপর্যায়ে সব বঞ্চনা (খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান প্রভৃতি) বিবেচনায় দারিদ্র্য মূল্যায়ন করা উচিত এবং এতে কে দরিদ্র ও কী কারণে দরিদ্র, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। বৈশ্বিক পর্যায়ে মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান এই তিন মাত্রার ওপর ভিত্তি করে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয়। এই তিন মাত্রা অনুধাবনে আবার ১০টি সূচক ব্যবহার করা হয়। তার মধ্যে পুষ্টি, শিশুমৃত্যু, শিক্ষা গ্রহণের বছর, স্কুলে উপস্থিতি, খাবার পানি, স্যানিটেশন, বিদ্যুৎ, রান্নার জ্বালানি ব্যবহার ও অন্যান্য সম্পদের হিসাবের সূচকে ধরা হয়। বাংলাদেশের প্রণীত প্রথম এসডিজি ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউতে ২০১৭ সালে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। পরে জাতিসংঘে পেশকৃত ২০২০ সালের ভলান্টারি রিভিউতে এমপিআই গঠন করার কথা বলা হয়। একইভাবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়ে বহুমাত্রিক সূচক গঠনের মাধ্যমে সরকার বহুমাত্রিক দারিদ্র্য মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের কথা বলা হয়। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপ কেন গুরুত্বপূর্ণ? প্রথমত, আর্থিক দারিদ্র্য পরিমাপ অর্থ-বিবর্জিত বঞ্চনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করে না। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য আর্থিক দারিদ্র্যের বিকল্প নয়, এটি এর পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে দারিদ্র্যের তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এটি হচ্ছে দরিদ্র মানুষের মধ্যে যারা দরিদ্র তাদের বঞ্চনার হিসাব। তৃতীয়ত, নৈতিক ও নীতিগত প্রেরণা ছাড়াও এর তিনটি ভিত্তি রয়েছেÑ(১) কারিগরি ভিত্তি, অর্থাৎ আমরা এখন এটি হিসাব করার পদ্ধতি জানি, যা ‘আলকায়ার-ফস্টার মেথড’ নামে পরিচিত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবিনা আলকায়ার ও জেমস ফস্টার এটি প্রবর্তন করেন; (২) আমাদের এখন অনেক তথ্য-উপাত্ত রয়েছে, যার মাধ্যমে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য হিসাব করা সম্ভব; (৩) দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের প্রতিজ্ঞা ও নীতি চাহিদা। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের কিছু সুবিধা রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑএর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিকরণকে জোরালো করা যায়, অর্থাৎ এসডিজির মূলমন্ত্র ‘কাউকে পেছনে রেখে নয়’ বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। আরও একটি সুবিধা হচ্ছে, সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করে বঞ্চনাভিত্তিক মানববৈষম্যকে কমিয়ে আনার কার্যকর ভিত্তি তৈরি করা যায়।

বাংলাদেশে অভাবনীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং আয়ভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসনে এদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ দারিদ্র্য মূল্যায়নের প্রতিবেদনে (২০১৯) বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনকে উদ্দীপনামূলক গাঁথা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ২০০০ সালের পর থেকে দেড় দশকে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার বাইরে চলে এসেছে। দারিদ্র্য নিরসনে সব খাতের অবদান রয়েছে। দারিদ্র্য কমার পাশাপাশি মানবপুঁজির বিকাশ, নারীপ্রতি জন্মহার কমানো এবং প্রত্যাশিত গড় আয়ুর বৃদ্ধি ঘটেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো গ্রামীণ দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা মোট দারিদ্র্য হ্রাসে ৯০ শতাংশ ভূমিকা রেখেছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি যত উন্নয়ন পরিকল্পনা বা কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, তার মূল কেন্দ্রে ছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তি। যেমন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) প্রথম এবং সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য (the foremost objective) ছিল দারিদ্র্য বিমোচন। যদিও দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল প্রবৃদ্ধি অর্জন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমানো ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি। এসব সত্ত্বেও এর মূল কেন্দ্রে ছিল দারিদ্র্য। এরই ধারাবাহিকতায় তৃতীয় থেকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্য বিমোচন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে নয়া জাতীয় পরিকল্পনাসমূহে সবসময় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।

উপরোক্ত বিষয় থেকে এটি স্পষ্ট যে, আমাদের দেশে ও আয়-ব্যয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের পাশাপাশি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের সময় এসেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তান তাদের দেশে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হিসাব প্রচলন করেছে। মধ্য আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে হলে আমাদের শুধু আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ল্যাটিন আমেরিকায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের মাধ্যমে জাতীয় নীতি প্রণয়নের জোয়ার এসেছে। এ প্রসঙ্গে কলম্বিয়ার কথা বিশেষভাবে বলা যায়, বিশ্বের মধ্যে তারাই প্রথম জাতীয় উন্নয়ন নীতিতে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপ অন্তর্ভুক্ত করেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের টেকসই উন্নয়নে অভীষ্ট বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রয়েছে। বিশ্বের ৭০-টির অধিক দেশ এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদনে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের মাধ্যমে অগ্রগতি তুলে ধরেছে। কাজেই বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? এসডিজির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার অপূর্ব সুযোগ এসেছে। এসডিজিতে সাফল্য অর্জন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে এক অপূর্ব সুযোগ। বাংলাদেশ এমডিজির সময়ে এই সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে। সুতরাং এখন এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।

এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে ২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে নিয়ে ইউনিসেফের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এর ওপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপিএইচডিআই (ওপিএইচআই) কর্তৃক পরিচালিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে এর কারিগরি সহযোগিতায় একাধিক সূচক ক্লাস্টার সমীক্ষা ২০১২-১৩-এর ওপর ভিত্তি করে একটি অনুশীলনমূলক বহুমাত্রিক সূচক গঠন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি খসড়া সূচক সমষ্টি গঠন করা হয়। এটি গঠনের জন্য প্রথমে যারা এর ওপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাদের নিয়ে একটি কারিগরি টিম গঠন করা হয়। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ, থিংক-ট্যাংক, উন্নয়ন সহযোগী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কারিগরি কমিটিও গঠন করা হয়। সূচক গঠনের প্রক্রিয়ার সব ধাপে মন্ত্রণালয়/বিভাগের কর্মকর্তা, এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত গ্রহণ করা হয়। এই অনুশীলনে জাতীয় ও শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক দুইই গঠন করা হয় এবং একটি প্রাথমিক প্রাক্কলনও করা হয়। বৈশ্বিক বহুমাত্রিক সূচক পরিমাপের জন্য যেসব মাত্রা ও সূচক নেয়া হয়, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের দেশের বাস্তবতায় এই সূচকগুলো পরিমাপ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা আরও নিবিষ্টভাবে পরিবীক্ষণ করতে সক্ষম হবো। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যবর্তী মূল্যায়নের সময় যাতে আমরা এই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপের সূচক চূড়ান্ত করতে পারি, সে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। নবম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় আমরা পুরোপুরি এই সূচক কাজে লাগাতে পারব। তবে তার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে যথাসময়ে সমীক্ষা সম্পন্নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য দারিদ্র্য নিরসন অপরিহার্য উপাদান, তাই বহুমাত্রিক দারিদ্র্য নিরসনের মাধ্যমে কার্যত আমরা বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন তুলে ধরতে পারব। এর ফলে বাংলাদেশের বহিঃব্র্যান্ডিং আরও উজ্জ্বল হবে। আমাদের এখন সেদিকেই নজর দেয়া উচিত। অনেকগুলো বঞ্চনার সমন্বয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্য পরিমাপ করা হয়। যে দেশের মৌলিক অধিকারে বঞ্চণা বেশি, সে দেশের বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার তত বেশি হবে। তবে আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের তুলনায় এই হার তুলনামূলকভাবে বেশি হবে, এটি নিঃসন্দেহে বলা যায়। আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের হারের চেয়ে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার বাংলাদেশে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে পাইলট সমীক্ষায়।

প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়

ও একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ

খবরের লিঙ্কঃ https://sharebiz.net/বাংলাদেশ-ও-বহুমাত্রিক-দা/